রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৭:৩১ অপরাহ্ন
নিউজ ডেস্কঃ প্রশংসার ফুলের সৌরভে তাঁর মুখরিত হওয়ার সম্ভাবনা এখন যতখানি, এর চেয়ে বেশি নিন্দার কাঁটায় ক্ষতবিক্ষত হওয়ার চোখরাঙানি। সময় এমনই এক সন্ধিক্ষণে এনে দাঁড় করিয়েছে মাশরাফি বিন মর্তুজাকে।
যেখানে বাংলাদেশের ওয়ানডে অধিনায়ক এখন আর কিছুতেই ‘সবার’ নন। কারণ খেলা ছাড়ার আগেই রাজনীতির দুর্বোধ্য জগতে পা রেখে ফেলেছেন। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নড়াইল-২ আসনে আওয়ামী লীগের হয়ে ভোটযুদ্ধে নামছেন বলে বোধগম্য কারণেই অনেকের হৃদয়াসন থেকেও ছিটকে পড়েছেন। এই মাশরাফি তাই সর্বজনের নন। একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের ছাতার নিচে যাওয়া ‘বিভাজিত’ মাশরাফি।
বিভাজনে দ্বিখণ্ডিত মাশরাফি খেলোয়াড়ি জীবনে চড়াই-উতরাই কম পেরোননি। হোঁচট খেয়েছেন কিন্তু ঠিক উঠে দাঁড়িয়েছেন। ব্যর্থ হয়েছেন তবু সাফল্যের খোঁজে অক্লান্তে ছুটে চলা থামাননি। এটিও অস্বীকার করার উপায় নেই যে ভক্তদের সমর্থনও অনেক সময় ব্যর্থতার চাতাল ভেঙে বের করে এনেছে তাঁকে। কিন্তু সংসদ সদস্য পদপ্রার্থিতাই ‘নড়াইল এক্সপ্রেস’ আর তাঁর প্রতি নিরঙ্কুশ সমর্থনের মাঝে দেয়াল তুলে দাঁড়িয়ে গেছে।
যে দেয়ালে এমনিতেই ক্রমাগত সমালোচনার থাবা এসে আছড়ে পড়ছে। সে থাবা আপাতত এড়িয়ে চলার উপায় নেই। তবে উপায় আছে সে থাবাকে আরো বেগবান হতে না দেওয়ার। সে জন্য চাই পারফরম্যান্স।পারফরম্যান্স একটু এদিক-সেদিক হলেই যেখানে নির্বাচনী হাওয়ায় মনঃসংযোগ হারানোর মতো তিক্ত উপসংহারে পৌঁছে যাওয়ার আশঙ্কা জনগণের একাংশের, তখন ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজও মাশরাফিকে কঠিন আরেকটি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে চোখ রাঙিয়ে ছিল।
ক্যারিয়ারের গোধূলিলগ্নেও তাই তাঁর সামনে নতুন আরেকটি শুরুর ক্ষণ এসে উপস্থিত হয়েছিল। যে শুরু রাজনীতিক মাশরাফির খেলোয়াড় হিসেবে শুরুর। তাও আবার সেটি ২০০তম ওয়ানডে খেলার মাইলফলক ছোঁয়ার ম্যাচে। যখন রাজনৈতিক পরিচয় দিয়ে খেলোয়াড়ি কীর্তির অনেকখানি ঢেকে দেওয়ার জনমতও তৈরি হয়ে ছিল। সে জন্যই জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সাম্প্রতিক ওয়ানডে সিরিজে ২৮ ওভার বোলিং করে ১৬০ রান খরচায় মাত্র ১ উইকেট পাওয়ার পরিসংখ্যানও সম্ভাব্য সমালোচনার উপাদান হতে প্রস্তুত ছিল।
যদিও সেই পারফরম্যান্সে এশিয়া কাপ থেকে বয়ে আনা কুঁচকির চোটের প্রভাব ছিল। এর আগে এশিয়া কাপেও দুবাই এবং আবুধাবির প্রচণ্ড গরমের মধ্যে নিজেকে নিংড়ে দেওয়ার একাধিক উদাহরণও যেন তাঁর রাজনৈতিক পরিচয়ের আড়াল নিয়ে ফেলেছিল। যেখানে আফগানিস্তানের বিপক্ষে বাঁচা-মরার ম্যাচে পায়ের চোটে হুট করেই বোলিং থেকে নিষ্কৃতি চেয়েছিলেন মুস্তাফিজুর রহমান। নিজ দলের সেরা বোলারকে বিশ্রাম দিয়ে ডেথ ওভারে বোলিংয়ের ঝুঁকি যখন নিয়েছেন অধিনায়ক, ততক্ষণে জয়ের পথ খোলা হয়ে গিয়েছিল আফগানদের। এর আগে কিছুটা ম্লান অধিনায়ক ওই সময়ে করা ৩ ওভারেই জ্বলে ওঠেন। ৭৮ রানের তৃতীয়উইকেট পার্টনারশিপ যেমন ভাঙেন, তেমনি ফেরান উইকেটে থিতু হওয়া দুই ব্যাটসম্যান হাশমতউল্লাহ শহীদি ও আসগর আফগানকে।
তখন প্রশংসিত মাশরাফির বর্তমান অনেক কিছুই কেড়ে নিতে মুখিয়ে ছিল। সেই সময়েই নতুন শুরু তাঁর এবং তাতেও ঝলমলে ‘বিভাজিত’ মাশরাফি আপাতত পারফরম্যান্স দিয়েই এড়ালেন নিন্দার কাঁটা। প্রথম বলে বাউন্ডারি ও শেষ বলে ছক্কা হজম করে নিজের ১০ ওভার শেষ করার তথ্য ক্যারিবীয়দের বিপক্ষে প্রথম ওয়ানডের মাশরাফিকে বোঝাতে পারছে না একটুও। বাউন্ডারির মারে শুরুর পরও তাঁর প্রথম স্পেলই সেটি বোঝাতে যথেষ্ট : ৭-০-১৪-২। দ্বিতীয় স্পেলের প্রথম বলে ক্যারিবীয় অধিনায়ক রোভম্যান পাওয়েলকেও তুলে নেওয়া মাশরাফি ৩০ রান খরচায় ৩ উইকেট নেওয়ার পথে ডট বলও করেছেন ৪১টি। ক্যারিবীয়দের দুই শর কমে আটকে ফেলা বোলিংয়ের পর তাই বাংলাদেশ অধিনায়কের ম্যাচসেরা হওয়া নিয়েও ছিল না সামান্যতম সংশয়।
রাজনৈতিক পরিচয়ই শুধু তাঁকে নিয়ে সংশয়ের যত বাতাবরণ তৈরি করেছিল সাধারণ্যে। করেছিল বলেই নিকট অতীতের সাফল্য নয়, জিম্বাবুয়ে সিরিজের ব্যর্থতায় আলো ফেলার লোকেরও অভাব ছিল না। অথচ ২০১৪ সালে অধিনায়কত্ব ফিরে পাওয়ার পর থেকে বল হাতে তাঁর চেয়ে অনুকরণীয়ও আর কেউ নন। এই সময়ের মধ্যে ৬১ ম্যাচে ৮১ উইকেট নিয়ে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি মাশরাফিই। এ ক্ষেত্রে তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী সাকিব আল হাসান (৫৭ ম্যাচ খেলে নিয়েছেন ৭৪ উইকেট) ক্যারিবীয়দের বিপক্ষে প্রথম ওয়ানডের পরও অধিনায়কের পেছনেই।
অধিনায়ক সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন গত জুলাইয়ের ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরেও। টেস্ট সিরিজে বিধ্বস্ত দল প্রথম ওয়ানডেতেই পেয়েছিল জয়ের দেখা। আর ৪৮ রানের সেই জয়ে দলের সেরা বোলার ছিলেন ৩৭ রানে ৪ উইকেট নেওয়া মাশরাফিই। তা নিয়ে বিপুল চর্চা হয়তো এই সিরিজের আগেও চলত কিন্তু চলেনি।
এখনকার মাশরাফি যে রাজনৈতিক বিভাজনে দ্বিখণ্ডিত মাশরাফি!